মেয়েদের প্রস্রাবের রাস্তায় জ্বালাপোড়া কেন হয় ও ঘরোয়া চিকিৎসা

প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া বা ডিউরিয়া, মেয়েরই অতি পরিচিত একটি সমস্যা। যদিও এটি মারাত্মক কোন রোগ নয়, কিন্তু কখনো হালকা চিনচিন ব্যথা, আবার কখনো তীব্র জ্বালা—যা দৈনন্দিন জীবনকে একেবারে থামিয়ে দেয়। আবার এটি কোন রোগের উপসর্গ হতে পারে। 

প্রস্রাবের রাস্তার মুখে জ্বালাপোড়া সাধারণত মূত্রনালীর সংক্রমণ (UTI), যোনিপথের শুষ্কতা অথবা যৌনবাহিত সংক্রমণের (STI) লক্ষণ হতে পারে। তবে এর আরও কিছু কারণ থাকতে পারে।  

এই সমস্যা থেকে হলে বাংলাদেশের অনেক মেয়েরাই দিশাহারা হয়ে পড়েন,সামাজিক কারনে কারো কাছে সাহায্য চাওয়া সম্ভব হয় না। তবে ভয়ের কিছু নেই, সঠিক চিকিৎসা আর কিছু ঘরোয়া প্রতিকার ব্যবহার করে আপনি খুব সহজেই এই অস্বস্তি থেকে মুক্তি পেতে পারেন। 

চলুন, তাহলে জেনে নিই এর পেছনের রহস্য এবং সমাধানের  উপায় সমূহ। 

মেয়েদের প্রস্রাবের রাস্তায় জ্বালাপোড়া কেন হয়

প্রস্রাবে সময় জ্বালাপোড়া হওয়ার বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি গুরুতর কিছু না হলেও, সঠিক কারণ নির্ণয় করে চিকিৎসা করানো জরুরি। 

নিচে প্রধান কিছু কারণ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:

১. মূত্রনালীর সংক্রমণ: এটি জ্বালাপোড়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ। আমাদের মূত্রনালী, মূত্রাশয়, এমনকি কিডনিতেও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হতে পারে। মেয়েদের ইউরেথ্রা ছোট হওয়ায় এবং মলদ্বারের কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় ব্যাকটেরিয়া সহজেই মূত্রনালীতে প্রবেশ করতে পারে। এই সংক্রমণে শুধু জ্বালাপোড়াই নয়, ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ আসা, ঘোলাটে বা দুর্গন্ধযুক্ত হওয়া, তলপেটে ব্যথা এবং কখনো জ্বরও হতে পারে।

২. যৌনবাহিত সংক্রমণ: কিছু যৌনবাহিত রোগ যেমন – ক্ল্যামিডিয়া, গনোরিয়া বা হারপিস ইত্যাদি প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়ার কারণ হতে পারে। এই সংক্রমণগুলো ইউরেথ্রাতে প্রদাহ সৃষ্টি করে, যার ফলে প্রস্রাবের সময় ব্যথা ও জ্বালা অনুভূত হয়। এক্ষেত্রে প্রস্রাবের সময় প্রদাহের পাশাপাশি যোনিপথে অস্বাভাবিক স্রাব, চুলকানি বা যৌন মিলনের সময় ব্যথাও থাকতে পারে।

৩. যোনিপথের শুষ্কতা বা অ্যাট্রফিক ভ্যাজাইনাইটিস: বিশেষ করে মেনোপজের পর মেয়েদের শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা কমে যায়। এর ফলে যোনিপথের টিস্যু পাতলা ও শুষ্ক হয়ে যায়, যা অ্যাট্রফিক ভ্যাজাইনাইটিস নামে পরিচিত। যোনিপথের শুষ্কতা একটি অন্যতম কারণ। এক্ষেত্রে যৌন মিলনের সময়ও ব্যথা হতে পারে।

৪. যোনিপথের সংক্রমণ: ইস্ট ইনফেকশন (ক্যানডিডিয়াসিস) বা ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিস (BV) এর মতো যোনিপথের সংক্রমণও প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়ার কারণ হতে পারে। যেহেতু যোনিপথ এবং মূত্রনালীর মুখ খুব কাছাকাছি থাকে, তাই যোনিপথের প্রদাহ প্রস্রাবের সময়ও অস্বস্তি সৃষ্টি করে। এই সংক্রমণগুলোতে যোনিপথে চুলকানি, অস্বস্তি, এবং অস্বাভাবিক গন্ধযুক্ত স্রাবও দেখা যেতে পারে।

৫. কিডনিতে পাথর: কিডনিতে পাথর থাকলে সেটি মূত্রনালীর ভেতর দিয়ে নিচে নামার সময় প্রস্রাবের রাস্তায় জ্বালাপোড়া, তীব্র ব্যথা এবং রক্তপাত ঘটাতে পারে। এই ব্যথা সাধারণত কোমর থেকে তলপেট পর্যন্ত বিস্তৃত হয় এবং তীব্র আকার ধারণ করতে পারে।

৬. রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শ: কিছু রাসায়নিক পদার্থ যেমন – সুগন্ধযুক্ত সাবান, বডি ওয়াশ, ডিটারজেন্ট, স্যানিটারি প্যাড, বা ভেজাইনাল স্প্রে যোনিপথ এবং মূত্রনালীর চারপাশে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে। এসব পণ্য ব্যবহার করার ফলে সংবেদনশীল ত্বকে জ্বালাপোড়া শুরু হয়, যা প্রস্রাবের সময় আরও বাড়তে পারে।

৭. মূত্রনালীর প্রদাহ (Urethritis) বা সিস্টাইটিস (Cystitis) (সংক্রমণ ছাড়া): অনেক সময় কোনো ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ছাড়াই মূত্রনালী বা মূত্রাশয় (ব্লাডার) প্রদাহযুক্ত হতে পারে। একে নন-ইনফেকশাস ইউরেথ্রাইটিস বা ইন্টারস্টিশিয়াল সিস্টাইটিস বলা হয়। এর কারণ সম্পূর্ণ স্পষ্ট না হলেও, এটি দীর্ঘমেয়াদী জ্বালাপোড়ার কারণ হতে পারে।

মহিলাদের প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া ঘরোয়া চিকিৎসা

প্রস্রাবের প্রদাহ কমাতে কিছু সহজলভ্য ঘরোয়া পদ্ধতি বেশ কার্যকর পালন করে। চলুন, দেখে নেওয়া যাক কোন কোন ঘরোয়া উপায়ে আপনি এই অস্বস্তি থেকে মুক্তি পেতে পারেন:

১. প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন:  প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া কমানোর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা অত্যন্ত জরুরি। যখন আপনি প্রচুর পানি পান করেন, তখন মুত্রাশয় থেকে ব্যাকটেরিয়া বেরিয়ে যেতে সাহায্য করে, অনেকটা পাইপ পরিষ্কার করার মতো। এটি প্রস্রাবকে পাতলা করে আর জ্বালাপোড়ার অনুভূতি কমায়। দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করার চেষ্টা করুন।

২. ডাবের পানি পান করুন: ডাবের পানি প্রাকৃতিক ইলেকট্রোলাইট আর খনিজ পদার্থে ভরপুর, যা শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করে। এটি কিডনির কার্যকারিতা উন্নত করতে আর প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া কমাতে সহায়ক হতে পারে। ডাবের পানি শরীরকে ডিটক্সিফাই করতেও সাহায্য করে, যা সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়।

৩. ক্র্যানবেরি জুস: ক্র্যানবেরি জুস ইউটিআই (UTI) প্রতিরোধে আর উপসর্গ কমাতে বেশ জনপ্রিয়। ক্র্যানবেরিতে এমন উপাদান থাকে যা ব্যাকটেরিয়াকে মূত্রনালীর দেয়ালে আটকে যেতে বাধা দেয়। তবে নিশ্চিত করুন যে আপনি ১০০% বিশুদ্ধ, চিনিবিহীন ক্র্যানবেরি জুস পান করছেন, কারণ অতিরিক্ত চিনি জ্বালাপোড়া বাড়িয়ে দিতে পারে।

৪. ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার: ভিটামিন সি মুত্রাশয়কে অ্যাসিডিক করে তোলে, যা ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোধে সাহায্য করে। কমলালেবু, লেবু, পেয়ারা, আমলকী ইত্যাদি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল নিয়মিত খেলে উপকার পেতে পারেন। লেবু পানি পান করাও একটি ভালো উপায়।

৫. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন: ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টয়লেট ব্যবহারের পর সবসময় সামনে থেকে পেছনে পরিষ্কার করুন, যাতে মলদ্বার থেকে ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালীর দিকে না আসে। সুগন্ধিযুক্ত সাবান, বডি ওয়াশ বা স্প্রে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন, কারণ এগুলো যোনিপথের প্রাকৃতিক পিএইচ (pH) ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে আর জ্বালাপোড়া বাড়াতে পারে। সাধারণ পানি দিয়ে পরিষ্কার করাই যথেষ্ট।

৬. সুতির অন্তর্বাস পরুন: সিন্থেটিক বা টাইট অন্তর্বাস পরিহার করুন। সুতির অন্তর্বাস বাতাস চলাচল ভালো রাখে, যা আর্দ্রতা কমায় আর ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধির জন্য প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করে। ভেজা অন্তর্বাস বা সাঁতারের পোশাক বেশিক্ষণ পরে থাকা থেকে বিরত থাকুন।

৭. ক্যাফিন আর অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন: ক্যাফিনযুক্ত পানীয় যেমন কফি, চা আর অ্যালকোহল মূত্রাশয়কে উদ্দীপিত করতে পারে আর জ্বালাপোড়ার অনুভূতি বাড়াতে পারে। তাই জ্বালাপোড়া থাকলে এগুলো কিছুদিনের জন্য এড়িয়ে চলা ভালো।

৮. প্রোবায়োটিক গ্রহণ: দই, ঘোল বা প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে শরীরের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য বজায় থাকে, যা যোনিপথ আর মূত্রনালীর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। উপকারী ব্যাকটেরিয়া ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে।

৯. উষ্ণ সেঁক বা হট কম্প্রেস: তলপেটে বা পেলভিক এরিয়ায় উষ্ণ সেঁক দিলে প্রদাহ বা ব্যথায় কিছুটা আরাম পাওয়া যায়। একটি গরম পানির বোতল বা উষ্ণ ভেজা তোয়ালে দিয়ে হালকাভাবে সেঁক দিতে পারেন।

তবে মনে রাখবেন, এগুলো প্রাথমিক উপশম মাত্র। যদি জ্বালাপোড়া তীব্র হয়, বারবার হয়, বা এর সাথে জ্বর, পেট ব্যথা, বা অন্য কোনো গুরুতর উপসর্গ থাকে, তবে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ঘরোয়া চিকিৎসাগুলো কেবল সহায়ক হিসেবে কাজ করে, মূল সমস্যার সমাধানে চিকিৎসকের ভূমিকা অপরিহার্য। এখন আপনি চাইলে ঘরে বসেই অনলাইনে ঢাকার সেরা মহিলা গাইকোলজিস্ট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন। 

গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন ও উত্তর

মেয়েদের প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া কীসের লক্ষণ হতে পারে?

এই সমস্যাটি ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI), কিডনির ইনফেকশন, বা হরমোন ভারসাম্যহীনতার কারণে হতে পারে।

কীভাবে বুঝব আমার ইউরিনে ইনফেকশন হয়েছে?

ঘনঘন প্রস্রাবের বেগ ও প্রস্রাবের সময় প্রদাহ,, ইউরিনের দুর্গন্ধ বা অস্বচ্ছতা, জ্বর ইত্যাদি ইউরিন ইনফেকশনের লক্ষণ।

ঘরোয়া উপায়ে ইউরিন ইনফেকশন কমানো যায় কি?

হ্যাঁ, পর্যাপ্ত পানি পান, লেবু পানি, তুলসী পাতা ও ক্র্যানবেরি জুস এই ধরনের ঘরোয়া চিকিৎসা UTI প্রতিরোধে সহায়ক।

প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া প্রতিরোধে কী কী অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত?

প্রতিদিন প্রচুর পানি পান, নিয়মিত টয়লেট ব্যবহার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং চিনি কম খাওয়া উপকারী।

শেষ কথা

মেয়েদের প্রস্রাবের সমস্যা সমাধানে ঘরোয়া চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর। তবে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা বা জটিলতা দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করাই উত্তম। নিয়মিত পানি পান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুললেই প্রস্রাবে জ্বালাপোড়ার মতো সমস্যার হাত থেকে বাঁচা সম্ভব।

Leave a Comment